কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আল্লাহ নিয়ামত বাড়িয়ে দেন


ড. মোহাম্মদ সাইফুল গণি নোমান প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ৩০, ২০২০, ১:৩০ অপরাহ্ন / ২৩৭
কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আল্লাহ নিয়ামত বাড়িয়ে দেন

আরবি শোকর শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো কৃতজ্ঞতা। দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন তা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকা ও আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করার নামই কৃতজ্ঞতা। সর্বোপরি আল্লাহর সব ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকাকেই সাধারণভাবে কৃতজ্ঞতা বা শোকর বলে। সাধারণত যেসব মানুষ যারা অল্পতেই তুষ্ট থাকেন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকেন তারা দুনিয়াতে সবচেয়ে সুখী হন। কোনো কিছুর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা মানুষের মানবীয় গুণাবলির মধ্যে সবচেয়ে উত্তম গুণ। এ কারণেই মুমিন বান্দারা সর্বদাই অল্পে তুষ্ট থাকেন এবং শোকর তথা কৃতজ্ঞতা আদায় করেন।

পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহহে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ করো; আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (সূরা আল-বাকারা : ১৫২)।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে আহসানুল বয়ানে বলা হয়েছে, এই অনুগ্রহ ও নিয়ামতের দরুন মানুষ আল্লাহর জিকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। অকৃতজ্ঞ হয়ে আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করে না। আর জিকর (স্মরণ) করার অর্থ হলো, সদা-সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা। অর্থাৎ, ‘তাসবিহ’ (সুবহানাল্লাহ), ‘তাহলিল’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং ‘তাকবির’ (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতে থাকা। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার অর্থ হলো, আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ও সামর্থ্যকে তাঁর আনুগত্যের পথে ব্যয় করা। আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিকে তাঁর অবাধ্যতায় ব্যয় না করা। এ রকম করলে আল্লাহর অকৃতজ্ঞ তথা নিয়ামতের কুফরি করা হয়। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে আরো অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ এবং অকৃতজ্ঞ হলে কঠিন শাস্তি পাওয়ার কথা এসেছে।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দান করব, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর’ (সূরা ইবরাহিম : ৭)।

সাধারণ ও বিশেষ নিয়ামতগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো। আল্লাহ ছাড়া কি কোনো স্রষ্টা আছে, যে তোমাদেরকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী থেকে রিজিক দান করে? তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। সুতরাং তোমরা বিপথে চালিত হচ্ছো কেন (সূরা আল-ফাতির : ৩)?’

আল্লাহর ইবাদত ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতার দায়িত্ব আদায়ের জন্যই আল্লাহ তায়ালা আমাদের এসব নিয়ামতরাজি দিয়েছেন। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব মানুষকে তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের কথা স্মরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারপর প্রশ্নাকারে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তা আছে কি, যিনি আকাশ-জমিন থেকে রিজিক দান করেন? না, তিনি ছাড়া কেউ নেই, তিনিই সৃষ্টিকর্তা, রিজিকদাতা এবং তিনিই একমাত্র মাবুদ।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এমন কে আছে যে, তোমাদেরকে রিজিক দান করবে, তিনি যদি রিজিক বন্ধ করে দেন? বরং তারা অবাধ্যতা ও সত্যবিমুখতায় অবিচল রয়েছে’ (সূরা মুলক : ২১)।

সুতরাং রিজিকদাতা যেহেতু আল্লাহ তায়ালা। তাই ইবাদত পাওয়ার অধিকার কেবল তাঁরই। তিনি ব্যতীত আর কারো ইবাদত করা যাবে না। যারা তাকে ব্যতীত অন্যের ইবাদত করে তারা হলো বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট। মানুষ অনেক নিয়ামতের কথা জানলেও অধিকাংশই তার অজানা থাকে। মানুষের অজান্তেই বহু নিয়ামত আল্লাহ মানুষকে দিয়ে থাকেন। অসংখ্য বিপদ-আপদ থেকে তাকে রক্ষা করেন। এ ছাড়া মানুষের কোনো ইচ্ছা ছাড়াই শরীরের অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার শরীর ও জীবনের উপকারার্থে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর নিয়ামতকে গণনা করতে চাইলেও তা গুনে শেষ করতে পারবে না’ (সূরা ইব্রাহিম : ৩৪)।

আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান আনা সবচেয়ে বড় শোকর বা কৃতজ্ঞতা। নিয়ামতের মধ্যে সবচেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা বা না-শোকরি হলো কুরআন ও সুন্নাহকে অস্বীকার করা। কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা না করা। সুতরাং, ইসলামকে অস্বীকার করে অন্য যেকোনো নিয়ামতের শোকর আদায় করলে তা কোনো কাজে আসবে না। কেননা আল্লাহ কৃতজ্ঞ বান্দাদের নিয়ামত স্থায়ী, বর্ধনশীল ও বরকতময় করার ওয়াদা করেছেন।

‘আল্লাহ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারীদের অচিরেই যথাযথ প্রতিদান দেবেন’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৪৪)।

আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহসমূহকে সর্বদা স্মরণ করা। তাঁর নিয়ামতরাজি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা। বিশেষভাবে চিন্তা করবে নিজের প্রতি আল্লাহ তায়ালার কত অগণিত নিয়ামতরাজি সদাসর্বদা বর্ষিত হচ্ছে তখনই কেবল হৃদয়ের গভীর থেকে বের হবে শুকরিয়ার প্রবহমান ধারা।

যেমন, সব নিয়ামতকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনে করা ও কোনো নিয়ামত সাময়িক হাতছাড়া হয়ে গেলে তাকেও নিজের জন্য কল্যাণকর মনে করা।

উল্লেখ্য, আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত কোনো নিয়ামতের ভিত্তিতে শুধু মুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেই শোকর আদায়ের জন্য যথেষ্ট হবে না; বরং প্রকৃত শোকর হলো নিয়ামতের ভিত্তিতে মনে মনে আল্লাহর প্রতি প্রফুল্ল হওয়া এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে নিয়ামতদাতা আল্লাহর হুকুম পালনে তৎপর হওয়া। তবে সাথে সাথে খুশিতে মুখ থেকে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বের হলে সেটাও ইবাদত বলে গণ্য হবে এবং সওয়াবের উপকরণ হবে।

রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় না।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস নং-১৯৫৪)

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, মানুষের অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় করা আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতারই অংশ। ইসলামের শিক্ষা তো এমন, যদি কেউ তোমার সাথে অসদাচরণ করে তবুও তুমি তার প্রতি ভালো আচরণ করো; তোমার কোনো আত্মীয় যদি তোমার সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলো। উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাটা খুব জরুরি। এতে করে উপকারী মানুষটা আরো বেশি উপকার করার উৎসাহ পায়। পৃথিবীতে এমনিতেই উপকারী মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। আর আমাদের অকৃতজ্ঞতা প্রতিদিন তাদের সংখ্যা আরো কমিয়ে দেয়। সমাজে চলতে আমাদের অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এ সহযোগিতা যে কেবলই বিপদ ও সঙ্কটের মুহূর্তে প্রয়োজন হয় এমন নয়, বরং সহযোগিতা প্রয়োজন হয় খুশি ও আনন্দের প্রতিটি উপলক্ষেও।

অতএব আমাদের সবার উচিত আল্লাহর প্রতিটি নিয়ামতরাজির শোকর তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁরই অনুগ্রহ লাভে সামনে এগিয়ে যাওয়া। আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দাহ হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসলামী গবেষক