করোনা আবহে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দুশ্চিন্তা ও মানসিক অস্থিতিশীলতা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায়ঘুম না আসার প্রবণতা প্রকট হচ্ছে। রাতে ঘুম না আসার ফলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতে কাজ-কর্মসহ সবকিছুতে অমনোযোগী হওয়ায় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে মানুষের জীবনে। মানুষের এই ঘুম না আসাকে বলে ইনসমনিয়া। একজন মানুষের যেকোনো বয়সে এক সপ্তাহ ধরে যখন ঘুম আসে না বা ঘুম আসার পর সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না সেটা হলো অ্যাকিউট ইনসমনিয়া। আর যখন প্রায় তিন মাস ধরে এই অবস্থা চলে তখন সেটা ক্রনিক ইনসমনিয়া। চিকিৎসকের মতে, ইনসমনিয়া দূর করতে পারে পর্যাপ্ত ঘুম।
স্বাভাবিক বা সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। কাজের চাপ বা ব্যস্ততা খুব বেশি থাকলেও প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। দিনে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমালে সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে সাধারণত, পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ৭-৮ ঘণ্টা, শিশুদের ৯-১৩ ঘণ্টা, একেবারে ছোট বাচ্চাদের ১২-১৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমানোর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, অনেক রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়, মন সতেজ থাকে আবার কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ঘুমানোর সময় শরীরের কোষগুলো বিশ্রাম পায় এবং সেই সঙ্গে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় টক্সিন নামক একটি পদার্থ। ভালো ঘুম ওষুধের থেকেও ভালো কাজ করে।
কোনো রকম ওষুধের প্রয়োগ ছাড়াই যদি রাতে আরাম করে ঘুমোতে চান এবং ইনসমনিয়া থেকে মুক্তি পেতে চান তাহলে যোগব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। কয়েকটি যোগ ব্যায়াম আছে যা রাত্রে খাওয়ার পর অভ্যেস করলে ঘুমোতে কোনো অসুবিধা হয় না।
দেখা গেছে, যারা সারাদিন কোনো শারীরিক পরিশ্রম করেন না, তাদের রাতে ঘুম আসতে অসুবিধা হয়। কারণ তাদের কোনো এনার্জি ক্ষয় হয় না। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন হালকা এক্সারসাইজ করুন। আপনি সকালে আধ ঘণ্টা হাঁটুন, স্কিপিং করুন। এতে রক্ত চলাচল বাড়বে এবং আপনার রাতে ঘুম ভালো হবে।
ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার খান। ম্যাগনেসিয়াম হলো এমন একটি খনিজ যা পেশীকে শিথিল করতে এবং স্ট্রেস কম করতে সাহায্য করে। তাই যে সব খাবারে ম্যাগনেসিয়াম আছে সেগুলো খাওয়া শুরু করুন। ডার্ক চকোলেট, বাদাম, অ্যাভোকাডো এগুলোতে ম্যাগনেসিয়াম আছে। রাত্রে এগুলো খেলে ভালো উপকার পাবেন।
ল্যাভেন্ডার অয়েল ভালো ঘুম নিয়ে আসে ও আপনার মুড উন্নত করে এবং শরীরের ব্যথা কমায়। এটি অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ হিসেবেও কাজ করে। তাই শোয়ার আগে বালিশে এই অয়েল ছড়িয়ে দিন (অনিদ্রা দূর করার ঘরোয়া উপায়)। একটু আলাদা করে শুঁকে নিন বা এই তেল গোসলের পানিতে মিশিয়ে গোসল করুন।
মেলাটোনিনযুক্ত খাবার খান। মেলাটোনিন হল এমন একটু বস্তু যা ভালো ঘুম নিয়ে আসতে সাহায্য করে। শুধু ঘুম আসতে নয়, ঘুম যাতে দীর্ঘস্থায়ী আর ঘন হয়, সেটাও করে এই মেলাটোনিন। টম্যাটো, বেদানা, শসা, ব্রোকোলি, সরিষা, আখরোট ইত্যাদিতে মেলাটোনিন থাকে। এগুলো প্রতিদিনের ডায়েটে যোগ করুন দেখবেন ঘুমের সমস্যা অনেকটাই কমে গেছে। সূর্যের আলোতেও কিন্তু মেলাটোনিন থাকে তাই সূর্যের আলোও গায়ে লাগাবেন।
গরম দুধ অনিদ্রা কমাতে ভীষণ কাজে লাগে। গরম দুধে থাকে ট্রিপটোফ্যান নামে অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা সিরোটোনিন হিসেবে কাজ করে। এই সিরোটোনিন ঘুম আনতে সাহায্য করে। তাছাড়া দুধে ক্যালসিয়ামও থাকে, যা ঘুমের জন্য সহায়ক।
রাতে এক চামচ মধু সুনিদ্রার জন্য দারুণ সহায়ক। মধু শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া এতে থাকা ট্রিপটোফ্যান মস্তিষ্ক শিথিল করতে সাহায্য করে। তাছাড়া মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী হরমোন কমাতেও সাহায্য করে মধু।
কলাও অনিদ্রা কমাতে সাহায্য করে। কলাতে আছে ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম; যা মাংসপেশি শিথিল করে। আর পেশি শিথিল থাকলে রাতে দ্রুত ঘুম আসে। তাই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটি করে কলা খাওয়া উপকারী।
চেরি মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সহজেই। চেরি হচ্ছে সেই সব ফলের মধ্যে অন্যতম যাতে রয়েছে মেলাটোনিন। চেরি ফলের মেলাটোনিন শরীরে এমন কিছু হরমোন তৈরি করে যেগুলো ঘুম নিয়ে আসে দ্রুত।
পাশাপাশি মাথা ম্যাসাজ এবং কিছু সময়ের জন্য গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলেও মাংশপেশি শিথিল হয়। এটিও অনিদ্রা দূর করতে সহায়ক।
রাত্রে বেশি চা বা কফি পান করবেন না। ট্যানিন ও ক্যাফিন স্নায়ু উত্তেজিত রাখে।
রাত্রে গ্যাজেট থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। ঘুমানোর সময়ের অন্তত এক ঘণ্টা আগে মোবাইল, ল্যাপটপ ও টিভি বন্ধ করে দিন।
শুতে যাওয়ার আগে এক কাপ ক্যামোমাইল টি পান করুন। ক্যামোমাইল ভালো ঘুম নিয়ে আসে।
ঘুমনোর সময় রাত্রে কড়া আলো জ্বালিয়ে রাখবেন না। এতে চোখের কোষ উত্তেজিত থাকে।
ঘুমনোর আগে বই পড়া ও সুদিং মিউজিক শোনার অভ্যেস গড়ে তুলুন।
বেশি ঝাল মশলা দেয়ার খাবার খাওয়া বন্ধ করুন (অনিদ্রা দূর করার ঘরোয়া উপায়)। জাঙ্ক খাবার এড়িয়ে চলুন।
মদ্যপান ও ধূমপান নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এগুলো কিন্তু ঘুম না আসার মূল কারণ।
যে সব খাবারে হাই প্রোটিন আছে বা সুগার আছে, সেই জাতীয় খাবার খেলে রাত্রে ঘুম আসতে অসুবিধে হয়। মিষ্টি খাবার, হাই প্রোটিন খাবার রাত্রে না খাওয়াই ভালো।
ঘুমের আগে দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল, কম্পিউটার, ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলোর আলোর কারণে ঘুম আসতে দেরি হয়।
রাত্রে খুব বেশি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ঘুমের আগে পেট অতিরিক্ত ভর্তি করে খেলে ঘুম ভালো হবে না।
আপনার যদি ঘুম না আসে তাহলে বিছানা থেকে উঠে বই পড়ুন অথবা শরীর/মন উত্তেজিত হয় না এমন কোনো কাজ করুন। ঘুম ঘুম ভাব এলে আবার বিছানায় যান।
আপনার বেডরুমকে আরামদায়ক করুন। ঘরটা যেন অন্ধকার ও শব্দহীন এবং খুব বেশি গরম অথবা ঠান্ডা না হয় তার দিকে খেয়াল রাখুন। যদি শব্দের সমস্যা থাকে তাহলে এয়ারপ্লাগ পরে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। বিভিন্ন পজিশনে শুয়ে দেখুন কোনটাতে আপনি সবচেয়ে বেশি আরাম অনুভব করছেন।
ঘুমের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং একই সময়ে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করুন। দিনের বেলা না ঘুমানোর চেষ্টা করুন। দিনের বেলা ঘুমালে রাত্রে ভালো ঘুম হয় না। নির্দিষ্ট সময় ঘুমানোর অভ্যেস করলে ঘুম না আসার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
আপনার মতামত লিখুন :