সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়: প্রধানমন্ত্রী


নিজস্ব প্রতিবেদক, অধিকার কণ্ঠ প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ৭, ২০২১, ৪:০৯ অপরাহ্ন / ২১৯
সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব এখন চোখে পড়ার মতো বলে। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- জাতির পিতার এ পররাষ্ট্রনীতিকে পাথেয় করে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ বিশ্বে এখন সমীহ করার মতো নাম। জাতির পিতার বৈদেশিক নীতিকে পাথেয় করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারী) বর্তমান সরকারের দুই বছরপূর্তী এবং তৃতীয় বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং মাঠ প্রশাসনের সদস্যসহ সম্মুখসারির করোনাযোদ্ধাদের আন্তরিক এই মহামারি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করায় ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিন বলেন, করোনাকালেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার বেড়েছে এবং তা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।গত অর্থবছরে আমাদের জিডিপি ৫.২৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের প্রাক্কলন অনুয়ায়ী এ বছর জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭.৪ শতাংশে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের অবস্থান হবে এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। আইএমএফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী শীর্ষদেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ২০২০-এ মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে।‘

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূল করে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতা মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধশালী-মর্যাদাশীল দেশ। আমরা ২০২১ সালের পূর্বেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। প্রত্যাশিত লক্ষে পৌঁছতে আমরা পথ-নকশা তৈরি করেছি। রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে।‘

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আমাদের বহুল আরাধ্য নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন পদ্মাসেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পদ্মাসেতুর ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামি বছর এই স্বপ্নের সেতু যানবাহন এবং রেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে। অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্পগুলির কাজও পূর্ণোদ্দমে এগিয়ে যাচ্ছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানো হয়েছে। শিগগিরই জাপান থেকে ট্রেন ঢাকায় পৌঁছবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে আমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির কথা একবার স্মরণ করুন। কী দুঃসহ পরিস্থিতি ছিল সে সময়। বিদ্যুৎ কখন আসবে আর কখন যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘ-মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে আজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছি। ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ২০০৫-০৬ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পায়রাতে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে জাতীয় গ্রিডে ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো বর্তমানে যা ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে ২০১৮ থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে।

রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী এবং মাতারবাড়িসহ আরও ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। সব ঘর আলোকিত হবে। এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজের ৮০ শতাংশ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।‘

‘নির্ধারিত সময় ২০২৩ সালের এপ্রিল নাগাদ এই ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে।’

‘চট্টগ্রামে কর্ণফুলির নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই ট্যানেলের ৬২ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে।’

খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ং-সম্পূর্ণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৯-২০ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল চার কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ থেকে তৃতীয় স্থান উন্নীত হয়েছে। অব্যাহত নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। শুধু ২০১৯-২০ বছরে কৃষিখাতে ৭ হাজার ১৮৮ কোটিরও বেশি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ং-সম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।‘

দেশের প্রায় সকল গ্রামে পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পল্লি এলাকায় ৬৩ হাজার ৬৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, তিন লাখ ৭৬ হাজার ব্রিজ-কার্লভার্ট, এক হাজার ৬৮৫টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, ৯৩৬ টি সাইক্লোন সেন্টার এবং ২৪৯টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।‘

‘২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক ৪ বা তদুর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আরও ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক চার এবং তদুর্ধ্ব লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬.৭৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে। ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১ হাজার ১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪২৮টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আমরা যমুনা নদীর উপর ৪.৮ কিলোমটির দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছি। লোকোমোটিভ যাত্রীবাহী ক্যারেজ এবং মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০টি। এ সময় বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১৩৭টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে।‘

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজ দেশে ফেরৎ পাঠানোর সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজারে বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ভাষাণচরে ১ লাখ মানুষের বসবাসোপযোগী উন্নতমানের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে শুধু স্ব-ইচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাঠানো হচ্ছে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

‘বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের বিমানবহরে ১২টি নতুন অত্যাধুনিক বোয়িং এবং ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। গত মাসে ১টি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। চলতি মাসে আরও ২টি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ সংযোজিত হবে।‘

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে আসুন আমরা নতুন করে শপথ নেই – মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শকে ধারণ করে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। করোনাভাইরাসের এই অমানিশা দ্রুত কেটে যাক, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এই প্রার্থনা করি। ততদিন আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন করুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।‘