আজ (২৯ ডিসেম্বর) একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। কুড়িগ্রামের ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধানে গিয়ে দুঃখজনক ভাবে ফেরির ছাদ থেকে পরে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একটি স্মরণীয় নাম চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন। শুধু সাংবাদিক নন, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ডেস্কে বসে সাংবাদিকতা নয়, তিনি ছিলেন তৃণমূল মানুষের সংবাদকর্মী, ছিলেন জনগণের সাংবাদিক। খবরের অন্তরালে যে সব খবর লুকিয়ে থাকে তিনি সেই সব তথ্যানুসন্ধান এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে। গ্রামে গঞ্জে, পথ থেকে পথে ঘুরে ঘুরে এই তথ্যানুসন্ধানী সংবাদকর্মী তাঁর সাংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমেই অমর হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়।
তিনি তাঁর কর্ম জীবনে সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৯৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপস্ পুরস্কার। তাঁর প্রাপ্ত সম্মাননা ও পদকের তালিকা এতো দীর্ঘ যে লিখতে গেলে লেখার কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। তবে মোনাজাত উদ্দিন এই পুরস্কারের চাইতেও বড় পুরস্কার মনে করতেন মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধা ও ভালবাসাকে। যা তিনি অকুণ্ঠই পেয়েছেন।
মোঃ মোনাজাত উদ্দিন-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্ণেয়া গ্রামে। রংপুর শহরের ধাপ এলাকায় ছিল তাঁর আবাস। রংপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের নিসবেতগঞ্জ সরকারী প্রাইমারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। কিছু দিন শিক্ষকতার পর তিনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর কাছে এই পেশা ভালো লাগেনি, তিনি মানিয়ে নিতে না পেরে চাকুরী ছেড়ে দেন। এছাড়া তিনি কিছুকাল কাজ করেন রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ক্যাটালগার হিসেবে। হাতের লেখা সুন্দরের কারণে এই কাজটি তিনি অনায়াসেই পরিছন্নভাবে করতে পারতেন। ছাত্র জীবনেই তাঁর লেখালেখির সূচনা। সাংবাদিক হিসেবে প্রথম তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। এর পরে একে একে দৈনিক আজাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় কাজ করেন তিনি। ‘সংবাদ’ই ছিল তাঁর ঠিকানা। বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। তবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন রংপুরের প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক রংপুর’ এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে। স্বাধীনতার পর ‘দৈনিক রংপুর’ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতে তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন। ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাত্ক্ষণিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
নাসিমা আক্তার ইতির সাথে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মোনাজাত উদ্দিন ও নাসিমা আক্তার ইতি’র দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মাহফুজা মাহমুদ চৈতি ও হোসনাতুল ফেরদৌস দুই বোন। দুজনেই ডাক্তার। একমাত্র ছেলে আবু ওবায়েদ জাফর সাদিক সুবর্ণ (১৯৭৪-১৯৯৭) ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় আত্মহত্যা করে।
মোনাজাত উদ্দিনের প্রকাশিত গ্রন্থ : মোনাজাত উদ্দিন তাঁর সাংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। রিপোর্টিং ছাড়াও গল্প, কবিতা, ছড়া ও নাটক রচনায় তাঁর দক্ষতা ছিল। তাঁর মৃত্যুর আগে ৯টি ও পরে ২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’: ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’। এছাড়াও মাসিক মোহাম্মদি, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। নাটকের একমাত্র প্রকাশিত বই ‘রাজা কাহিনী’। এছাড়া তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :