হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। রবিবার দুপুর একটার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশের প্রবীণ এই আলেম বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
নূর হোসাইন কাসেমীর ছেলে জাবের কাসেমী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার বাবার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। কাসেমীর জানাজা আগামীকাল সোমবার সকাল ৯টায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি।
গত ১ ডিসেম্বর ঠান্ডাজনিত কারণে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে নূর হোসাইন কাসেমীকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েক দফা পরীক্ষা করলেও তার করোনা নেগেটিভ আসে।চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার দুপুরে অক্সিজেনের মাত্রা ও রক্তচাপ কমে যাওয়ায় তাকে প্রথমে হাই ডিপেন্ডসি ইউনিটে (এইচডিইউ) নেয়া হয়। পরে অবস্থার আরও অবনতি হলে রাত ৮টায় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। শুক্রবার সকালে অক্সিজেনের মাত্রা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনও স্বাভাবিক হয়। কিন্তু দুপুরের পর তার শারীরিক অবস্থার আবার অবনতি ঘটে।
আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী দেশের শীর্ষ আলেমদের অন্যতম। তিনি সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। এছাড়া তিনি কওমি মাদ্রাসাগুলোর সম্মিলিত বোর্ড আল-হাইয়্যাতুল উলয়া লিলজামিয়াতিল কওমিয়ার কো-চেয়ারম্যান এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন।
রাজধানীর বারিধারা জামিয়া মাদানিয়ার প্রিন্সিপালসহ অসংখ্য দীনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আল্লামা কাসেমী। সারাদেশে তার হাজার হাজার ছাত্র ও ভক্ত-অনুরাগী রয়েছেন। তার মৃত্যুতে ইসলামি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
আল্লামা কাসেমীর বর্ণাঢ্য জীবন
নূর হোসাইন কাসেমী ১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়ির পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। এখানে চতুর্থ শ্রেণি শেষ করে চড্ডার কাশিপুর কাশেমুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন বরুডার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায়। এখানে হেদায়া জামাত (স্নাতক ২য় বর্ষ) পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার উদ্দেশ্যে ভারতে গমন করেন। নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পেরে ভর্তি হন ভারতের সাহারানপুর জেলার বেড়ীতাজপুর মাদ্রাসায়। এখানে জামাতে জালালাইন (স্নাতক) সমাপ্তির পর দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যান। দেওবন্দ মাদ্রাসায় তার অধ্যয়নকাল মোট তিন বছর। এখানে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সমাপ্তির পর আরবি সাহিত্য ও দর্শনে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন।
ভারতের মুজাফরনগর জেলায় মুরাদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। এখানে এক বছর শিক্ষকতার পর ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস ও মুহতামিম পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় চলে যান। এখানে তিনি চার বছর শিক্ষকতা করেছেন এবং ছাত্রাবাস পরিচালক ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি কাজী মুতাসিম বিল্লাহ প্রতিষ্ঠিত জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে চলে আসেন। এখানে তার অধ্যাপনাকাল মোট ছয় বছর। এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা এবং ১৯৯৮ সালে জামিয়া সোবহানিয়া মাহমুদ নগর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের শায়খুল হাদিস ও মহাপরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি প্রায় ৪৫টি মাদ্রাসা পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলেন।
২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আইন অনুসারে একই সাথে তিনি আল হাইআতুল উলয়ার সহ-সভাপতি ছিলেন।তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর । এর পূর্বে তিনি হেফাজতের ঢাকা জেলার সভাপতি ছিলেন।
১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি খতমে নবুয়ত আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯০ সালে তিনি জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন এবং ৭ নভেম্বর ২০১৫ সালে তিনি এর মহাসচিবের দায়িত্ব লাভ করেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি দুই ছেলে যুবায়ের হুসাইন ও জাবের কাসেমী এবং দুই মেয়ের জনক।
আপনার মতামত লিখুন :